
কালবৈশাখী ঝড়। ছবি: শামছুল হক রিপন
চৈত্রের শেষ দিন। গরমে পুড়ে যাচ্ছে যেন চরাচর, সেই সঙ্গে আমাদের ছোট্ট মাটির ঘরটাও। বাতাস বন্ধ, চারপাশ নিস্তব্ধ। দাদি বারান্দায় বসে বলছিলেন, ‘বুঝলি? এই রকম গুমোট গরমে না প্রকৃতি কিছু একটা করে বসে...’
সেই বিকেলেই বাবা গিয়েছিলেন বাইরে। একটু পরই অন্ধকার গিলে ফেলল গোটা গ্রাম। ঈশান কোণ থেকে ধেয়ে এলো বিশাল কালো মেঘ, তারপর সেই পরিচিত শো শো শব্দ, হাওয়া আসছে। বিদ্যুৎ চলে গেল, তারপর শুরু হলো ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি আর মুহুর্মুহু বজ্রপাত। আমাদের ঘরের টিনের ছাদটা এই তাণ্ডবে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে বা উড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল।
আমরা তখন ঘরের এক কোণে জড়ো হয়ে আছি। হারিকেনের আলোয় ছোট ভাইটা কাঁপছে, মা দোয়া পড়ছেন, দাদি জানালা শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, বাবা কোথায়?
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ...
মা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখলেন, বাবা দাঁড়িয়ে, ভিজে একেবারে সিক্ত। সেই মুহূর্তে বাইরে ঝড় চললেও আমাদের ঘরে যেন একরাশ শান্তি ফিরে এলো। আমরা সবাই একসঙ্গে, আবার।
সেই রাতে আমাদের বাড়ির ছাদ কাঁপছিল, জানালা কাঁপছিল, কিন্তু একটা জিনিস অটুট ছিল, আমাদের পরিবারের বন্ধন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, কালবৈশাখী শুধু প্রকৃতির তাণ্ডব নয়, আমাদের ভেতরের টেকসই ভালোবাসাকেও পরীক্ষা করে।
কালবৈশাখী কেন হয়
‘কালবৈশাখী’- এই শব্দটা শোনামাত্রই বুকের ভেতর এক অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসে। কিন্তু এই ঝড় আসলে কী? কেন হয়, কখন হয়?
কালবৈশাখী হচ্ছে একটি স্থানীয় ধরনের বজ্র বৃষ্টিপাত ও দমকা হাওয়াসহ ঝড়, যা মূলত বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে। বাংলায় ‘কাল’ মানে ধ্বংস আর ‘বৈশাখী’ বোঝায় বৈশাখ মাসকে। মূলত বৈশাখে এই ঝড় প্রবল হয় বলেই এই নাম।
সাধারণত মার্চের শেষ থেকে মে মাস পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড় হয়ে থাকে। সর্বাধিক ঘটে এপ্রিল ও মে মাসে, বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে।
সাধারণত বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে এই ঝড় শুরু হয় এবং প্রায় ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
এই ঝড়ের পেছনে রয়েছে প্রকৃতির এক আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, বঙ্গোপসাগর থেকে গরম ও আর্দ্র বাতাস উঠে আসে উত্তর দিকে। একই সময় হিমালয় থেকে ঠান্ডা, শুকনা বাতাস আসে দক্ষিণ দিকে।
এই দুই বিপরীত প্রকৃতির বাতাস যখন একসঙ্গে মিশে যায়, তখন তৈরি হয় ঘন কালো মেঘ-বজ্রসহ ঝড়।
আরেকটু ব্যাখ্যা করে বললে এই অঞ্চলের মাটি ও বাতাস বিকেলের প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, ফলে বাতাস ওপরের দিকে উঠে গিয়ে নিম্নচাপ তৈরি করে। আর এই নিম্নচাপের ফলে হিমালয়ের উচ্চচাপ এলাকা থেকে হঠাৎ হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস ধেয়ে আসে। যার ফলাফল কালবৈশাখী।
ঝড়ের গড় গতিবেগ
এ ধরনের ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। কোনো কোনো সময় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতেও ধেয়ে আসে।
এটি উড়োজাহাজ চালনাকে বিপজ্জনক করে তোলে, ফলে অনেক সময় ফ্লাইট বাতিল বা স্থগিত করতে হয়। এ ছাড়াও গ্রামে গাছে, খড়ের ঘর, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
নিরাপদ থাকবেন যেভাবে
১. ঝড়ের আশঙ্কা থাকলে নিরাপদভাবে ঘরের ভেতরে অবস্থান করুন। জানালা ও দরজা ভালোভাবে বন্ধ করুন।
২. দুর্ঘটনা এড়াতে বাড়ির বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ রাখুন।
৩. গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, টিনের চাল বা বাঁশের ঘর ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে দূরে থাকুন।
৪. স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল ইত্যাদির নম্বর মোবাইলে সেভ করে রাখুন।
বাইরে থাকলে কী করবেন
১. খোলা মাঠ বা নিচু জায়গায় অবস্থান বিপজ্জনক হতে পারে, তাই দ্রুত নিরাপদ আশ্রয় নিন।
২. ঝড়ের সময় গাছপালা ও বৈদ্যুতিক লাইনের নিচে আশ্রয় নেওয়া বিপজ্জনক।
৩. কালবৈশাখী চলাকালে নৌকা বা ছোট নৌযান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
ঝড়ের পর করণীয়
১. ঝড়ের পরে বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি বা বিপজ্জনক কিছু রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করুন।
২. কোনো বিপদ দেখা দিলে স্থানীয় প্রশাসন বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিন।
তবে শুধু ক্ষয়ক্ষতির গল্প নয়, কালবৈশাখী অনেক সময় হয়ে ওঠে আশীর্বাদ। এর বৃষ্টিপাত ধান ও পাটের জন্য উপকারী। আসামে চা চাষের জন্য এই সময়কার বৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া গরমের অসহনীয় দাবদাহ থেকে এক ধরনের স্বস্তিও এনে দেয় এই ঝড়।
কেমন হবে ২০২৫ সালের আবহাওয়া?
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বছর গ্রীষ্মকাল স্বাভাবিকের চেয়ে উষ্ণতর। ফলে কালবৈশাখীর সময় এগিয়ে এসেছে এবং প্রাথমিক দিকেই অনেক অঞ্চলে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ বছরের মাঝামাঝি সময়েও কালবৈশাখী ঝড় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
বাংলাদেশের রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে এপ্রিলের শুরুতে একাধিক কালবৈশাখী হয়েছে। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামেও হঠাৎ কালবৈশাখী আঘাত হানছে।